রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৭ অপরাহ্ন
চিররঞ্জন সরকার:
মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম। মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, রাজনৈতিক ও সমাজচেতনা বিকাশ, শাসক ও শাসিতের ভূমিকা বিশ্লেষণ, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, আবিষ্কার ও উদ্ভাবন দিয়ে সমাজ প্রগতিতে বুদ্ধিজীবীরা অপরিমেয় অবদান রাখেন। বাংলাদেশের ইতিহাসেও বুদ্ধিজীবীদের এই ভূমিকা রয়েছে। স্বদেশ চেতনা গড়ে তোলা, শাসকের শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অধিকারকে যুক্তি দিয়ে তুলে ধরা, স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ দেখানোর ক্ষেত্রে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাদের অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতার ধারাবাহিক পথেই আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ।
এখানে প্রশ্ন আসে, কারা বুদ্ধিজীবী? বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীকোষ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে “বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। যারা দেশের স্বাধীনতাকে ভিত্তি করে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তাদের বিচার, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে কাজ করে।”
অন্যদিকে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে “যারা সমাজ ও সংস্কৃতি সচেতন এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে দক্ষ সুশিক্ষিত মানুষ, যারা বুদ্ধির বলে বা বুদ্ধির কাজ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।”
ইতালির বামপন্থি বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, সাংবাদিক আন্তোনিয়ো গ্রামশি-কে মুসোলিনি কারারুদ্ধ করেছিলেন (১৯২৬-৩৭)। গ্রামশি তার কারাগার জীবনের নোটবইতে লিখেছিলেন, “সব মানুষই বুদ্ধিজীবী, কিন্তু সমাজে সবার ভূমিকা বুদ্ধিজীবীর নয়।”
আরেক দার্শনিক অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের মতে বুদ্ধিজীবী এমন একজন ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট বার্তা, একটি দৃষ্টিভঙ্গি ও একটি সুচিন্তিত মতামত জনগণের সামনে তুলে ধরেন। কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে সত্য প্রকাশ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।
সমাজে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা নির্ণয় করা খুব সহজ নয়। আসলে ‘বুদ্ধিজীবী’রা যন্ত্রণাদায়ক ইনজেকশনের মতো। সাধারণেরা কখনই তার উপকারিতা বোঝে না। কিন্তু সমাজবিকাশে এবং মানস গঠনে তাদের অবদান অপরিসীম।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’-তে সংস্কৃতির দৈন্যদশা বর্ণনা করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে বেশ ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগই মানুষের প্রতি তাদের মর্যাদাবোধের পরিচয় দেন না। যে শ্রমজীবী মানুষ ‘ইতিহাসের নির্মাতা’ তাদের জীবনযাপনকে ‘তত্ত্ব’ দিয়ে নয়, তাদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে জীবনের গভীর সত্যকে অনুসন্ধান না করলে বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর দায় সুসম্পন্ন হয় না।
ব্যবহারিক বুদ্ধিজীবী নন, প্রকৃত প্রস্তাবে চিন্তানায়ক যিনি হন, স্বধর্মেই তাকে হতে হয় রাজনৈতিক শিবিরের বেড়াজালমুক্ত। বাধ্যবাধকতার বাঁধনহীন। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে মাথায় তুলে নাচা বা পক্ষে সওয়াল করার দায় তার থাকে না। কোনো দলের ‘ঘরের লোক’ হয়ে উঠবার তাগিদ তিনি অনুভব করেন না। এ কালের সংকট এই যে, ‘সেল’ বা বাহিনীর রমরমা এখানে স্বাধীন চিন্তানায়কের এই ধারণাটিকেই প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। দিগ্ভ্রষ্ট পথিককে দিশা দেখানোর মতো বাতিঘর এমনিতেই আজ বিলুপ্তপ্রায়। তদুপরি বুদ্ধিজীবী নামধারী পারিষদবর্গের ঐকান্তিক চেষ্টাই এই, যাতে বাহিনী-বহির্ভূত কোনো স্বর তার অস্তিত্বই টিকিয়ে রাখতে না পারে। তাতে শুধু যাবতীয় বিরোধিতা মুছে ফেলার সুবিধাই হয় না, বাহিনীর বাইরে থাকার ব্যবস্থাটাই নষ্ট করে দিয়ে এক ‘নিও-নর্মাল’ ঘরানা প্রতিষ্ঠা করা যায়, যেখানে আত্মীকৃত বুদ্ধিজীবীকেই নিরপেক্ষ ভাবুক বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। অভিসন্ধিই হবে যাবতীয় চিন্তা-ভাবনার একমাত্র চালিকাশক্তি।
কোনো মতাদর্শের প্রতি তার বিশ্বাস থাকতে পারে, কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে তার নৈকট্য থাকতে পারে, তিনি কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশও হতে পারেন। কিন্তু এর কোনোটিই তার ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে না, তার সত্তাকে মুঠোয় পুরে ফেলে না। প্রকৃত বুদ্ধিজীবী তিনিই, যিনি মানুষের স্বার্থে কথা বলেন, কিন্তু জনতার কোলাহলে একাকার হন না। তার স্থান ঝাঁকের বাইরে, স্রোতের বিপরীতে। তিনি কখনো কারও মুখপাত্র নন। তিনি যদি কোনো মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তা যুক্তির কষ্টিপাথর, নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ বলেই। স্বার্থে নয়, ভাবাবেগে নয়, ভয়ে বা মোহে নয়, তাৎক্ষণিকতায় নয়। তাই বলে মানবিক দুর্বলতা, স্খলন, ক্ষুদ্রতা কি তার নেই? থাকতেই পারে। কিন্তু যেখানে বীক্ষার গভীরতার প্রশ্ন, চিন্তার শুদ্ধতার প্রশ্ন, ভাবনার সততার প্রশ্ন, সেখানে তিনি অজেয়। হাততালি বা চুনকালি, কিছুরই পরোয়া না করে তিনি থেকে যান নিষ্কম্প, বলে যান যা তার বলে যাওয়ার ছিল।
এ সব আকাশকুসুম কল্পনা নয়। সক্রেটিস থেকে সলজেনিৎসিন, অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ থেকে নোয়াম চমস্কি তারা প্রত্যেকেই পেরিয়ে এসেছেন এই অন্তবিহীন পথ। এ ক্ষেত্রে জ্যাঁ পল সার্ত্র’র নামটি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও দার্শনিক, অ্যাক্টিভিস্ট। সাহিত্যিক-দার্শনিকের গজদন্তমিনার ভেঙে বেরিয়ে এসে কখনো প্যারিসের রাস্তায় নিষিদ্ধ কাগজ ফেরি করে গ্রেপ্তার হচ্ছেন কিংবা সেই কাগজ সম্পাদনার দায়িত্ব নিচ্ছেন (১৯৭০), ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করছেন নোবেল পুরস্কার (১৯৬৫), আলজিরিয়া ও ভিয়েতনামের জন্য পথে নামছেন, পুলিশের গুলিতে শ্রমিকনেতা নিহত হলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিচ্ছেন, নির্বাচনকে বলছেন ‘উজবুকদের জন্য ফাঁদ’। প্রথম যুগ থেকেই সমকালীন সংস্কৃতির আমূল প্রত্যাখ্যান ছাড়া তরুণদের কোনো গত্যন্তর নেই বলে মনে করছেন তিনি। যিনি ব্যক্তি ও সামাজিক সংকটে অন্তহীনভাবে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চেয়েছেন, যিনি অক্লান্তভাবে জীবন ও জীবনভাবনাকে এক ধনুকের ছিলায় বেঁধে নিতে চেয়েছেন।
তিনি মনে করতেন, বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি ও বিশ্বাসের সততার যদি জোর থাকে, তবে সব অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নির্যাতিত ব্যক্তি তার দৃষ্টিশক্তি দিয়েই লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন। এই লড়াইয়ে শেষাবধি অত্যাচারিতেরই জয় হয়। সার্ত্র এ কথাটি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতেন।
তিনি শুধু নোবেল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তা নয়, লেজিয়ঁ দ্য অনারও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নোবেল প্রত্যাখ্যানের পর সার্ত্র বলেন যে, লেখকের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতাকে অক্ষুণœ রাখার জন্য তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির সঙ্গে জড়িত হতে চান না। তিনি চান না যে লেখক স্বয়ং প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুন।
কিন্তু এখন বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য লালায়িত। কেউ পুরস্কার পেলে বগল বাজাতে শুরু করেন। আর না-পাওয়ার দল শুরু করেন কুৎসা, গিবত। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি বঙ্গদেশে বহু অপব্যবহারে এখন এতটাই জীর্ণ যে তার মূল অর্থটির পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। শুধু স্বক্ষেত্রে কীর্তিমানই নন, যারা সমসময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকনির্দেশ করেন, ভবিষ্যতের পথ বাতলান বৌদ্ধিক চর্চার মাধ্যমে এবং গণপরিসরেও সেই চর্চার আবহ গড়ে তোলেন, তারাই সাবেকি অর্থে ‘বুদ্ধিজীবী’। সার্ত্র তার বিবৃতিতে এহেন বুদ্ধিজীবীদের (নেচে-গেয়ে-অভিনয় করে ‘বুদ্ধিজীবী’ তকমা পাওয়া সেলিব্রিটিদের নয়) সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রার্থিত সম্পর্কটির কথাই এক অর্থে মনে করিয়ে দেন। এই সম্পর্কের মূল ভিত্তিটি হলো একটি সম্মানজনক দূরত্ব। অর্থাৎ, ভাবনার স্বকীয়তা বজায় রাখতে হলে রাষ্ট্র নামক অসীম ক্ষমতাধর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয়।
শুধু বুদ্ধিজীবীর ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার দিক থেকে নয়, গণতন্ত্রের জন্যও সেটি জরুরি। কারণ গণতন্ত্রে ক্ষমতার বিরোধী স্বরের উপস্থিতি দরকার। এবং সেই স্বরটি কেবল প্রথাসিদ্ধ রাজনৈতিক বিরোধী দল জোগান দিতে পারে না, কারণ প্রকৃত প্রস্তাবে তারাও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থারই অংশবিশেষ। রাষ্ট্রই তাদের বিরোধীর মর্যাদা দেয়। কাজেই রাষ্ট্র-বহির্ভূত বিরোধিতার স্বর গড়ে তুলতে হয়। এবং সেই স্বর গড়ে তুলতে পারেন বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু এখন বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তারা রাষ্ট্রের হাতে তামাক খান আর পদ-পদবি-পুরস্কারের জন্য লালায়িত থাকেন। একটুখানি সুযোগ-সুবিধার জন্য তদবির করেন, লেজ নাড়েন।
বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দুঃখজনক। একজন বুদ্ধিজীবী কেন এমন হবেন? এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ‘জি হুজুর’ সংস্কৃতিটি এখনো অনড়। বুদ্ধিজীবীরাও যদি সেই সংস্কৃতির ধারক হয়ে ওঠেন, তাহলে ‘প্রথা’ ভাঙবে কে? পথ দেখাবে কে?
লেখক ও কলামনিস্ট
chiros234@gmail.com